Bee ধারাবাহিক উপন্যাসঃ নাইয়র (পর্ব-আট) Good Luck

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৯:১৪:৪৫ সকাল



একদিন গ্রামে খুব হৈ চৈ পড়ে গেলো।

খাঁ বাড়ির কমলার ছোট ছেলেকে জীনে ধরেছে। ওঝা এসেছে সেই জীন ছাড়াতে। সবাই ছুটছে খাঁ বাড়ির দিকে। ছোট-বড় পুরুষ-মহিলা সবারই জীন দেখার কৌতূহল। জীন দেখতে কেমন কিংবা সে তার ভয়ানক সব কর্মকান্ড নিয়ে কি করতে পারে, চলার পথে এমন সব মুখরোচক আলোচনায় সবাই মশগুল।

খাঁ বাড়ির উঠানে কমলার ছেলেটিকে একটি মাদুরে শুইয়ে রাখা হয়েছে। সে কাঁপছে... আর চোখ বড় করে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। ওর সামনে ওঝা নামের যে ভয়ানক লোকটি তার বোচকার ভিতর থেকে জীন তাড়ানোর ইন্সট্রুমেন্টগুলো বের করছে, তাকে দেখলে যে কেউই ভড়কে যাবে। জীনও মনে হয় পালাবে। একটা পাত্রে কিছু পানি রয়েছে। সেগুলো নাকি কোহেকাফ পর্বতের গা ঘেমে পড়া মন্ত্রপুত পানি। একটা কাঁচের কৌটায় কিছু রঙিন সূতা। সেখান থেকে লাল ও নীল রঙের দুটি সূতা নিয়ে এক সাথে গিট্টু দিয়ে কিছু মন্ত্র পড়ছে ওঝা । ওঝা কফিল। আশে পাশের গ্রামগুলোতে ওর নাকি খুব নাম ডাক। যে কোনো ধরণের জীন বা পরী তাঁকে দেখলেই নাকি কয়েকশো মাইল দূরে সরে যায়। যাবারই কথা। ওর পাশে মানুষও থাকবে না। ক'দিন গোসল করে না কে জানে? ভয়ংকর দুর্গন্ধ ওর শরীর ও পোষাকে।

মন্ত্র পড়া শেষে ওঝা কফিল সুতাটি কমলার 'জীনে ধরা' ছেলের ডান হাতে বেঁধে দেয়। এরপর কোহেকাফ পর্বতের মন্ত্রপুত পানি ছেলেটির সারা শরীরে গোলাপ জলের মতো ছিটিয়ে দিতে থাকে। সেই সাথে অদ্ভুদ সব শ্লোক বলে যেতে থাকে। ছেলেটি শরীরে পানি লাগতেই সিটিয়ে যায়... ওর কেঁপে উঠার মাত্রা আরো বেড়ে যায়। উপস্থিত সকলেই মন্ত্রপুত পানির ভয়ংকর তেজ দেখে একে অন্যের মুখের দিকে চায়। দৃষ্টিতে মিশে আছে, ' দেখলে তো! ওঝা কফিল কতটা সিদ্ধপুরুষ... এবার জীন ব্যাটা পালাতে পারলেই বাঁচে'। ওদিকে ওঝা ছেলেটির চার পাশে ঝিনুকের একটি অংশ দিয়ে মাটির উঠোনে গোল বৃত্ত আঁকে। এরপর একটি বড় ময়ুরের পাখনা দিয়ে ছেলেটির মাথার চুল থেকে পা পর্যন্ত ওর নগ্ন শরীরে বুলাতে থাকে।

একই সাথে কফিল নিজের ভুতপুর্ব কঠিন কঠিন জীন তাড়ানোর কাহিনীও বলতে থাকে। সে সব শুনে উপস্থিত সকলে চমৎকৃত হয়। কফিলের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা ভক্তি আরো বাড়ে। কমলার ছেলের উপরে ভর করা অদৃশ্য জীনকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন কথা বলতে থাকে। তবে ছেলেটি কিছুক্ষণ পর পর কেঁপে উঠা ছাড়া আর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। অনেকেই আশা করেছিল এইবার হয়তো ছেলেটির ভিতর থেকে জীন বের হয়ে আসবে। আর কফিলের কথামতো যে কোনো কিছু একটা মুখে নিয়ে চলে যাবে। অধিকাংশ সময় জীনেরা ময়লা নোংরা ঝাটা মুখে করে চলে যায়। কেউ বা উঠানের বড় গাছটির মগডালটি ভেঙ্গে দিয়ে যায়। মোটকথা সে যে ছিল এবং চলে গেলো তার প্রমানস্বরুপ এমন কিছু একটা করে দেখায়। তবে কমলার ছেলেটির কোন ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। শুধু ওর চক্ষু রক্তবর্ণ থেকে আর গাঢ় বর্ণ ধারণ করছে। সেই সাথে ম্যালেরিয়া রোগীর মতো কাঁপছে... হাত পা গুটিয়ে নিজেকে শামুকের মতো খোলসে সেধিয়ে দিতে চাচ্ছে যেন।

ওঝা দেখে কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। জীন কোনো রা ও করছে না। এ তো বিপদ! সবার সামনে মান-সম্মান আজ চলেই কি যায়। এবারে ছোট্ট একটা গর্ত করে ছেলেটির মাথার একটু সামনে। ঝোলা থেকে একটা ফ্রাই প্যান জাতীয় ছোট্ট কড়াই বের করে। সেখানে কিছু শুকনো মরিচ পুড়তে দেয়। আর একটা নতুন নারিকেলের শলার তৈরী ঝাঁটা হাতে নিয়ে ওঝা কফিল প্রস্তুত হয়। আজ যেভাবেই হোক জীন ব্যাটাকে সে এক হাত দেখে নিবে।

খালের পাড় দিয়ে মোতাহারকে সাথে নিয়ে পারুল হেঁটে যাচ্ছিলো। দুজনেই খুব গম্ভীর। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য একজন নারী ডাক্তার স্থায়ী ভাবে আনার কতই না চেষ্টা করলো। কিন্তু এখনো কোনো ভালো খবর পেলো না। পারুলের পরিচিত সেই সহকর্মী ওকে আশ্বাস দিয়েই যাচ্ছে। কিছু না কিছু একটা হবেই। দুজনেই এই ব্যাপারটি নিয়েই খুব টেনশনে আছে। গ্রামের গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জিম্মা পারুল নিজের কাঁধে নিয়েছে। ও সেই দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারবে তো? না হলে হাবিব মুন্সীর কাছে সে হেরে যাবে। ওর হারাটার চাইতেও বড় হলো, এক একটি আসন্ন মৃত্যুকে অসহায় ভাবে চেয়ে চেয়ে দেখতে হবে... কিছুই করতে না পারার কষ্ট সয়ে সয়ে।

এমন সময় কয়েকজনকে দ্রুত ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে হেঁটে যেতে দেখে। ওরা জীন নিয়ে কিছু কথা-বার্তা বলতে বলতে যাচ্ছিলো। পারুলের মনোযোগ কেড়ে নিলো ওদের কথাগুলো। সে ওদেরকে ডাকে। ওরা থামে। প্রশ্ন করতেই সব কিছু জানা হয়ে যায় পারুল এবং মোতাহারের। দু'জনের নিঃশব্দ দৃষ্টি বিনিময় হয়... এবং মহিলা ডাক্তারের প্রসঙ্গটা ওদের ব্রেইন থেকে অদৃশ্য হয়ে সেখানে জীনের ওঝা কফিল জেঁকে বসে। পারুল এবং মোতাহার খাঁ বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। একটু দ্রুত পদেই হেঁটে যায় ওরা। হাতে সময় খুব কম।

পারুল এবং মোতাহার যখন খাঁ বাড়ির উঠানে প্রবেশ করল, তখন ওঝা ছেলেটির নাকের কাছে পোড়া শুকনো মরিচ নিয়ে ভয়ংকর ভাবে চিৎকার করছে, ' ওঠ... হারামজাদা... যা ভাগ শয়তান' । আর মরিচের বিষাক্ত ধুঁয়ায় ছেলেটির দম বন্ধ হয়ে আসছিলো... সে ধনুষ্টংকার রোগীর মতো কাশতে কাশতে বেঁকে যাচ্ছিলো। আর ওঝা কফিল হাতের ঝাটাটি দিয়ে ছেলেটিকে অনবরত প্রহার করে চলেছে। এই অমানবিক দৃশ্যটি দেখে পারুল নিজেকে আর সম্বরণ করতে পারে না। প্রায় ছ'ফিট লম্বা ওঝাকে হাতের ধাক্কায় এক পাশে সরিয়ে দেয়। এরপর কমলার অসুস্থ ছেলেটিকে পরম মমতায় নিজের বুকে তুলে নেয়। ছেলেটিকে স্পর্শ করতেই পারুল চমকে উঠে। প্রচন্ড জ্বরে কাঁপছে সে। হয়তো ১০৩ ডিগ্রী ক্রস করেছে বা করতে যাচ্ছে। দ্রুত মোতাহারকে বলে ওকে নিয়ে উপজেলায় যাবার জন্য। ওঝা কিছু বলার চেষ্টা করতেই মোতাহার সজোরে এক চড় বসিয়ে দেয় ওর গালে। লাথি দিয়ে ওর বোচকা বাতি সব ছড়িয়ে ফেলে দেয়।

হাতে সময় কম দেখে কমলা আর ওর স্বামীকে বলে, ' তোমার ছেলের প্রচন্ড জ্বর। আর এই জ্বরের কারণেই সে আবোল-তাবোল বকেছে। এটাকে জীনে ধরার লক্ষণ বুঝে ছেলেটাকে আর একটু হলে তো মেরেই ফেলেছিলে। ওকে উপজেলায় নিয়ে যাচ্ছি।' মোতাহারের মটর বাইকটি খালের পাশে বড় রাস্তায় রেখে এসেছে। তাই ছেলেটিকে পারুলের হাত থেকে নিজের কোলে নিতে নিতে ওঝাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ' আর যদি তোকে কোনোদিন আমার চোখের সামনে দেখেছি, চরম শিক্ষা দিয়ে দিবো আজ বলে দিচ্ছি। মানুষ ঠকিয়ে অনেক খেয়েছো। আর না... অন্তত এই গ্রামে আর না।'

একটি গ্রামের অশিক্ষা-আর কুসংষ্কারের অন্ধকারের আড়ালে কফিলের মতো এই সব ভন্ড ওঝা এবং গ্রাম্য তুকতাক জানা ব্যক্তিদের আবির্ভাব ঘটে। অদৃশ্য শক্তিধর জিনিসের প্রতি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি সারেন্ডার করে এসেছে যুগ যুগ ধরে... একটু রহস্যের ঘ্রান পেলেই সেখানে ঐশ্বরিক কিছু একটা লুক্কায়িত মনে করে সেখানেই মাথা কুটে মরে। নিজের চিন্তার গণ্ডী পার হয়ে গেলেই তখন এই সব তুকতাক চিকিৎসার উপর নির্ভর করে। আর এটাই জন্মের পর থেকে সবাই দেখে আসছে। হাবিব মুন্সীর মত প্রভাবশালীদের প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত হওয়াটা এতো সহজ কাজও তো নয়। একজন ডাক্তারের সুচিন্তিত প্রেসক্রিপশন এর থেকে হাবিব মুন্সীর এক বোতল পানি পড়া এখানে গ্রামবাসীর কাছে বেশী জরুরী। আর এসব অভ্যাসের ফলেই হয়ে এসেছে... চলছে... কিন্তু এখনই কিছু একটা করা না গেলে সামনেও চলতে থাকবে। কফিলের মতো ভন্ড ওঝা খালের পানি পাত্রে ভর্তি করে রাখলেও সাধারন মানূষের কাছে তা কোহেকাফ পর্বতের মন্ত্রপুতঃ পানি মনে হবে... লাল-নীল সূতা আসলে কিছুই না... মন্ত্র পড়াটাও একধরণের ভড়ং মাত্র। এ সব কিছু আসলে সাধারন জনগনের দৃষ্টিকে আসল ঘটনা থেকে আড়াল করার জন্যই করা। না হলে যে কেউ কমলার ছেলেটিকে ছুঁয়ে দেখলেই বুঝতে পারতো সে প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত। তার জন্য ওঝার নয় বরং ডাক্তারের দরকার। ওকে জীনে ধরে নাই... এই কথাটা বিশ্বাস করানোটাই অনেক শক্ত কাজ। কারন ওদের বিশ্বাসের গোড়ায় এমন মরিচা পড়েছে যে দু'এক ঘষায় সেই মরিচা যাবে না।

পারুল ও মোতাহার শ্রীরামকাঠী গ্রামের দুর্বল মানুষদের বিশ্বাসের গোড়ায় যে মরিচা লেগে রয়েছে, সেখানে ধীরে ধীরে রেতের মৃদু আঘাতের ব্যবস্থা করতে মরিয়া হয়ে আছে। নিজেদেরকে ওরা ভয়াবহ এক ঝুঁকির মুখেও এনে দাঁড় করিয়েছে... নিজেদের অজান্তে। কিন্তু ওরা জানলেও কি পিছিয়ে যেতো? অবশ্যই না। পারুল-মোতাহার-মুজিবরের মতো মানুষের জন্মই হয় প্রচন্ড কিছু ভালো কাজ করে ততোধিক প্রচন্ড এক ঝুঁকির প্রান্তে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া‍য়। ওরা কখনোই পিছাবে না... পিছায় ও না।

দেখা যাক, সামনে কি হয়।

... ... ...

সালমা মার্ডার কেসে অন্তরীণ কোব্বাত মিয়াকে জামিনে বের করে নিয়ে আসা হয়। পলাতক আসামী সাহাবুদ্দীন বি.এস.সিও আদালতে সারেন্ডার করে জামিনের আর্জি দেয়। আদালত প্রথমবার জামিন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন। দিন পনের পরে আবারও তার উকিল জামিনের প্রেয়ার দিলে আদালত জামিন মঞ্জুর করেন। এই সবক'টি ঘটনায় হাবিব মু্ন্সী প্রত্যক্ষ ভাবে অংশগ্রহন করে। শাহাবুদ্দীনের জামিনের জন্য সে বেশ মোটা অংকের টাকা খরচ করে।

সেদিন রাতে সাহাবুদ্দীনের জামিন হবার পর সবাই আবার হাবিব মুন্সীর বাড়িতে এক হয়। সবাই খুব গম্ভীর। কোব্বাত মিয়া তীব্র স্বরে হিসহিস করে উঠে। সবাই মনযোগ দিয়ে ওর কথা শোনে। সে বলে, ' আমাগো মান-সম্মান যা যাবার তা গ্যাছে। এখন সামনে কি করা লাগবে সেইটা ভাবেন। সুদের কারবার তো বন্ধ হইয়া গ্যালো। কৃষি ব্যাংকের থেই্ক্যা লোন নিয়া হগলডি আমাগো আসল শুদ্দা টাকা দিয়া দিছে। স্কুলডা আর বন্ধ করবার পারলেন না মনে হয়।' হাবিব মুন্সীর দিকে তাকিয়ে শেষ লাইনটা বলে কোব্বাত মিয়া। হাবিব মুন্সীর ভিতরে কো্নো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। কেবল কাঠের চেয়ারটায় নড়ে চড়ে বসে। কোব্বাত মিয়ার খুব রাগ হয়। সে এবারে খুব ঠান্ডা স্বরে বলে, ' আপনি দেহি কিছুই কইতাছেন না। জেল খানায় কিন্তু ঐ দিন আপনারো থাকা লাগতো। আপনের বিয়াইন না মরলে খবর আছিলো। আমরা দুইজন আপনের কামই করছালাম কিন্তু। আর একটা কথা, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে মাইয়া ডাক্তার আইতাসে শুনতাছি। একটা মাইয়া মাইনষের সাথে আমরা টক্কর দিয়া পারতাছিনা...'

হাবিব মুন্সী সাহাবুদ্দীনের দিকে তাকায়। বলে, ' তুমি কিছু বলবা মিয়া? একজনের কথা তো সবই শুনলাম।' সাহাবুদ্দীন কোব্বাতের মুখের দিকে তাকায়। একবার মালেক শিকদারকে দেখে। শেষে দু'পাশে মাথা নেড়ে জানায় কিছু বলবে না। মালেক শিকদারের দিকে হাবিব মুন্সী তাকালে সে বলে, ' আপনার উপর আমার বিশ্বাস আছে।' এটুকু কথাতেই যেন কত বিশাল কিছু একটা হয়ে যায় হাবিব মুন্সীর ভিতরে। সে আনন্দে ঝলমল হয়ে উঠে। মুখে হাসি টেনে কোব্বাত মিয়াকে বলে, ' এতো অল্পতে ভাইঙ্গা পড়লে চলে মিয়া? তোমার মনের অবস্থা বুঝতাছি... সুদের কারবার বন্ধ হইছে, তাতে তোমার একার তো লস হবে না। আমরাও তো আছি তোমার সাথে। আর লসের কথা উঠতাছে কেন? এ পর্যন্ত সবই তো লাভ হইছে। আসল টাকা সবই আমাদের আছে। চিন্তা-ভাবনা কইরা অন্য কোনো ব্যবসায় খাটাবো।'

একটু থেমে কোব্বাতের লজ্জা পাওয়া মুখটাকে দেখে হাবিব মুন্সী। ওর লজ্জিত হওয়াটাও তার পছন্দ হয়। লজ্জা পাওয়া মানে তার সামনে উচ্চ স্বরে কথা বলায় সে যে ভুল করেছে, সেটাই মেনে নেওয়া। চোখ বন্ধ করে হাবিব মুন্সী বলে যায়, ' দ্যাখো, আমরা একটা জোট। আমাদের টাকা-পয়সা আর প্রভাব প্রতিপত্তি মোতাহার আর ঐ মাইয়াডার থেকে অনেক বেশী। আর বাতি নিভবার আগে একটু বেশীই জইল্যা উঠে এইডা জানো তো? ওরে জ্বলতে দাও... নিভবার আগে শেষবারের মতো একটু ফাল মারতে দাও। আমার সব কিছু অনেক আগে থেকেই চিন্তা করা আছে। আমারে আমার মত কাম করতে দাও। খালি লগে থাইক্যো... মিয়ারা আমার পাছ ছাড়বানা। দেখতে থাকো... আমি কি করি।'

হাবিব মুন্সীর বাড়িতে দুষ্ট চক্রের সকল সদস্য সেই রাতে আবার নতুন করে যেন শপথ নেয়। সকল শুভকে পাশ কাটিয়ে অশুভ এই চক্রটি নিজেদের ভিতরের কালো প্রেতাত্মাকে জাগিয়ে তুলে গ্রামের আকাশ দিয়ে পৈশাচিক উল্লাসে উড়তে থাকে।

অনেক রাত...

প্রচন্ড এক দুঃস্বপ্ন দেখে পারুল জেগে উঠে। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। শরীর কাঁপছে থরথর করে। বিছানার পাশের টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটিকে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে নেয়। এক নিঃশ্বাসে পান করে। একটু দম নেয়।

আহ! এবারে শান্তি ! তবুও শরীরের কাঁপুনি থামে না।

আজ সকাল থেকেই ওর ভাল লাগছে না।একা একা কত কিছু ভাবে। ওর বিয়ের আগের সময়ের কিছু কথা মনে এসে ভীড় করে......ইদানিং ভাললাগাটার বড্ড আকাল যাচ্ছে ওর জীবনে। উপরে তাকালে যখন পুরো আকাশটাকে দেখা যায়... নীল আকাশে সাদা মেঘের ঊড়ে যাওয়া দেখতে খুব ভাল লাগে। মনে হয় সেও ঐ মেঘের সাথে উড়ে যাওয়া এক মেঘবালিকা।

মেঘবালিকা!

হ্যা, এই নামটি ই ওর নিজের জন্য পছন্দ হল। আজ থেকে নিজেকে সে এই নামে ডাকবে। এরপর অন্য কেউ ওকে কি নাম দিবে তার কি ঠিক আছে? বিয়ের আগে ভাবতো, কোথাকার কোন এক অপরিচিতর সাথে ওর বিয়ে ঠিক হতে যাচ্ছে। সে কেমন হবে? ওর মনের মতো হবে তো? ওর মনে কি ছিল সেই সময়?

মনের গভীরে পারুলের স্বপ্নটা ছিল এরকম... ... বিশাল একটা প্রান্তর। মেঘমুক্ত নির্মল আকাশ। সাদা মেঘবালিকাদের দ্রুত সঞ্চরণ। বাতাসের তার মাথার চুল উড়ে এলোমেলো। কিছু চুল এসে মুখকে ঢেকে দিচ্ছে। এই অবস্থায় ওর মনের ভিতরে যে অচেনা রাজপুত্রের ছবি আঁকা আছে, সে এলো। সবুজ ঘাসের উপর বসে থাকা মেঘবালিকার পাশে এসে নীরবে বসে। কোনো কথা নাই। নীরবতাই যেন কত কিছু বলে দিচ্ছে! দুজনের হৃদয়ের শব্দ ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে চলেছে। নীরব থেকেই দুজনের মনের কথা জানা হয়ে গেল। একসময় রাজপুত্র ওর ঘাড় ধরে ওকে তার নিজের দিকে ফেরায়। প্রচন্ড বাতাসে ওর মুখের উপর ঢেকে রাখা রেশমের মত চুলগুলোকে আলতো করে সরিয়ে গভীর ভাবে চোখে চোখ রাখে। রাজপুত্রের জোড়া ভুরুর কালো চোখের ভিতর সে হারিয়ে যেতে থাকে। অস্ফুটে শুধু রাজপুত্রকে বলে, ‘এতোদিন কোথায় ছিলে’!

কিন্তু এ সবই শুধু ওর কল্পনা।

জানালা দিয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে থাকে পারুল... আমাদের মেঘবালিকা! ওর মত আরো কিছু মেঘবালিকাদের ছোটাছুটি উপভোগ করতে চায়। কিন্তু রাতের অন্ধকারে আকাশের মেঘবালিকারা প্রচ্ছন্ন হয় না। সেও এক সময় একজন মেঘবালিকাই ছিল। কিন্তু সময় তার ডানাটা কেটে ফেলেছে... এখন আর উড়তে পারবে না... পারে না!

কিন্তু উড়বার তার বড় শখ ছিলো!!! Good Luck

(ক্রমশঃ)

বিষয়: সাহিত্য

১০২১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

262875
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ০৯:৩৩
কাহাফ লিখেছেন : ওঝা কফিলের পাছায় আরো জোরে কয়েক লাথি দেয়ার দরকার ছিল। কুসংস্কারে ঢুবে যাওয়া মুর্খ গ্রামীন জনগোষ্ঠিকে ওরা নিজ স্বার্থেই ব্যবহার করে। রহস্যময় অসম্ভব পর্যায়ের কিছু দেখলেই তার পিছনে ঈশ্বরিক শক্তির কল্পনাও অগ্গ্যতা। ইসলাম এমন বিষয় কে সমর্থন করে না। জ্বীন সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহের অবকাশ না থাকলেও ওদের কর্মকান্ড নিয়ে মনগড়া অনেক বিশ্বাস-কুসংস্কার সমাজে প্রচলিত,যা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। সুন্দর ও আকর্ষণীয় উপস্হাপনার জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ..... Rose
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ১২:৫৫
206602
মামুন লিখেছেন : আপনাকেও নান্দনিক মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
আর হ্যা, আমি মোতাহার হলে, ওঝা কফিলকে কষেই দিতাম দু'চারটা।
শুভেচ্ছা আপনার জন্য।Happy Good Luck
262947
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:০৬
সন্ধাতারা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম শ্রদ্ধেয় মামুন ভাইয়া। আপনার লিখা চমৎকার কাহিনীগুলো শেয়ার করার জন্য জাযাকাল্লাহ। Rose Rose Rose
262987
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:৫৮
মামুন লিখেছেন : ওয়ালাইকুম আসসালাম আপু।
আপনাকে ও অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর। Rose Rose Rose Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File